ইসরায়েলকে মার্কিন সমর্থনের পেছনের কারণ ও স্বার্থ
ঐতিহাসিক ও কৌশলগত সম্পর্ক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ঘনিষ্ঠ। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই আমেরিকা দেশটিকে সমর্থন দিয়ে আসছে। এই সম্পর্ক শুধুমাত্র কূটনৈতিক নয়; সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই মধ্যপ্রাচ্যে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। মধ্যপ্রাচ্য একটি কৌশলগত অঞ্চল যেখানে বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাসের মজুত রয়েছে। ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে আমেরিকা নিশ্চিত করতে চায় যে এই অঞ্চলে তার সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র সবসময় প্রভাবশালী থাকবে এবং মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবে।
প্রতিরক্ষা ও অস্ত্র ব্যবসা
ইসরায়েলকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়া মার্কিন প্রতিরক্ষা খাতের জন্য বিশাল এক বাজার তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ইসরায়েলকে প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দেয়, যা মূলত আমেরিকান অস্ত্র কোম্পানিগুলোর জন্য লাভজনক। ফলে ইসরায়েলের উপর মার্কিন সমর্থন এক ধরনের সামরিক শিল্পনীতির অংশও বটে।
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব
আমেরিকায় ইহুদি লবি অত্যন্ত শক্তিশালী, বিশেষ করে আমেরিকার রাজনীতিতে। আমেরিকান রাজনীতিতে ইসরায়েলপন্থী সংগঠন যেমন AIPAC (American Israel Public Affairs Committee) ও অন্যান্য ইহুদি গোষ্ঠীগুলোর শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ যোগান দেয়।
এছাড়া, খ্রিস্টান ইভানজেলিকাল গোষ্ঠীগুলোও ইসরায়েলের পক্ষে, কারণ তারা ধর্মীয়ভাবে বিশ্বাস করে যে ইসরায়েলকে সমর্থন করা তাদের খ্রিস্টান বিশ্বাসের একটি অংশ।
ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ও ইরানবিরোধিতা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শত্রুতা রয়েছে, বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তি অর্জন নিয়ে। আমেরিকা চায় ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে ইরানবিরোধী একটি শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে।
পশ্চিমা বিশ্বের ঐক্য ও আধিপত্য
ইসরায়েলকে সমর্থন করে আমেরিকা ইউরোপীয় দেশগুলোকেও একই অবস্থানে রাখার চেষ্টা করে। পশ্চিমা বিশ্ব যদি ইসরায়েলের পক্ষ নেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নেতৃত্ব আরও সুসংহত হয় এবং রাশিয়া-চীন বা অন্যান্য শক্তির প্রভাব কমানো সম্ভব হয়।
ফলাফল ও বর্তমান পরিস্থিতি
তবে এই দীর্ঘমেয়াদী সমর্থনের ফল হিসেবে ইসরায়েল একপ্রকার দায়মুক্তি ভোগ করছে। তারা ফিলিস্তিনিদের উপর নির্বিচারে হামলা চালিয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক কোনো বড় প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না, কারণ আমেরিকা জাতিসংঘে তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো কঠোর সিদ্ধান্ত আটকে দেয়।
বর্তমানে লেবাননে হিজবুল্লাহর উপর ইসরায়েলি হামলা ও গাজায় চলমান গণহত্যা পুরো অঞ্চলে আরও বড় সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমেরিকা প্রকাশ্যে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান করলেও, পর্দার আড়ালে তারা ইসরায়েলকে অস্ত্র ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
উপসংহার
ইসরায়েলকে মার্কিন সমর্থনের মূল কারণ হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং ধর্মীয় স্বার্থ। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বজায় রাখা, অস্ত্র ব্যবসা, ইহুদি লবির শক্তি ও ইরানবিরোধী অবস্থান ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার একনিষ্ঠ সমর্থনের মূল চালিকা শক্তি। তবে এই একপাক্ষিক সমর্থন মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার পরিবর্তে আরও সংঘাতের জন্ম দিচ্ছে, যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
0 মন্তব্যসমূহ