মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ও বিভক্তির পেছনের কারণ
মধ্যপ্রাচ্য, যাকে পশ্চিম এশিয়াও বলা হয়, এক বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় অঞ্চল। ভৌগোলিকভাবে এটি ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে অবস্থিত, যা একে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছে। তবে এই অঞ্চলটি বরাবরই সংঘাতপূর্ণ, বিভক্ত এবং রাজনৈতিকভাবে অস্থির। এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ—ধর্মীয়, জাতিগত, উপনিবেশিক উত্তরাধিকার, ভূরাজনীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য।
১. ঐতিহাসিক ও উপনিবেশিক উত্তরাধিকার
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান মানচিত্রের অধিকাংশই ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সৃষ্টি। ১৯১৬ সালে সাইকস-পিকো চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজস্ব স্বার্থে অঞ্চলটি ভাগ করে নেয়, যা বহু কৃত্রিম রাষ্ট্রসীমার সৃষ্টি করে। এর ফলে একই জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, আবার ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী একত্রে থাকতে বাধ্য হয়। এই জোরপূর্বক সীমানা বিভাজন আজও অনেক সংকটের মূল কারণ।
২. ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত
মধ্যপ্রাচ্য মূলত ইসলামের সূতিকাগার, যেখানে সুন্নি ও শিয়া দ্বন্দ্ব এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
- সৌদি আরব (সুন্নি) ও ইরান (শিয়া) এই দ্বন্দ্বের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।
- ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশে শিয়া-সুন্নি বিরোধ বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘাতে পরিণত হয়েছে।
- ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটও একটি অন্যতম ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংঘাত, যেখানে মুসলিম-ইহুদি দ্বন্দ্ব দীর্ঘকাল ধরে চলছে।
৩. প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূরাজনীতি
বিশ্বের বৃহত্তম তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার এই অঞ্চলে অবস্থিত। এই কারণে এখানে বিদেশি শক্তিগুলোর গভীর স্বার্থ রয়েছে।
- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করে।
- তেলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সৌদি আরব, ইরান, কাতার ও অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে।
- ইরাক যুদ্ধ, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইয়েমেন সংঘাতের পেছনে তেলের ভূরাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
৪. রাজনৈতিক স্বৈরাচার ও গণতন্ত্রহীনতা
মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অধীনে পরিচালিত, যেখানে রাজনৈতিক বিরোধিতাকে কঠোরভাবে দমন করা হয়।
- আরব বসন্তের সময় গণতন্ত্রের দাবিতে বিপ্লব শুরু হলেও অনেক দেশেই তা সফল হয়নি।
- সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনের মতো দেশে গৃহযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন।
৫. জাতিগত ও আঞ্চলিক বিভক্তি
- কুর্দিরা (যারা তুরস্ক, ইরাক, ইরান, সিরিয়ায় বিভক্ত) নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র চায়, কিন্তু তা কোনো দেশই স্বীকার করতে চায় না।
- লেবাননে মুসলিম-খ্রিস্টান বিভাজন, ইরাকে কুর্দি-আরব দ্বন্দ্ব, সুদান বিভক্তির মতো অনেক জাতিগত সংকট রয়েছে।
উপসংহার
মধ্যপ্রাচ্যের বিভক্তি ও অস্থিরতার পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক জটিলতা, ধর্মীয় মতপার্থক্য, ভূরাজনীতি ও তেলের প্রতিযোগিতা। উপনিবেশিক শক্তির চাপিয়ে দেওয়া মানচিত্র, বিদেশি হস্তক্ষেপ, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং জাতিগত সংঘাত এই অঞ্চলের সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। ফলে এটি এক অনবরত অস্থির ও সংঘাতময় ভূখণ্ড হিসেবে থেকে যাচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ